Saturday 23 May 2015

ইন্টারনেট ডট অর্গ নিয়ে যত বিতর্ক

ফেসবুকের ইন্টারনেট ডট অর্গ উদ্যোগের বিরুদ্ধে এখন অনেক গ্রুপ দাঁড়িয়ে গেছে। ফেসবুকের এই উদ্যোগটি নিয়ে নানা সমালোচনা করছে তারা। তাদের দাবি, ফেসবুকের এ উদ্যোগটি মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সমান সুযোগ, নিরাপত্তা, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও উদ্ভাবনের মতো বিষয়গুলোকে হুমকির মুখে ফেলছে।
বিনা খরচায় মানুষকে বেসিক ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়ার লক্ষ্যে চালু করা ফেসবুকের ইন্টারনেট ডট অর্গের বিরুদ্ধে ডিজিটাল রাইটস গ্রুপ নামের একটি কনসোর্টিয়াম দাঁড়িয়ে গেছে। এই গ্রুপটি ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গকে একটি খোলা চিঠি লিখেছে, যাতে দাবি করা হয়েছে ইন্টারনেট ডট অর্গ উদ্যোগটি ‘নেট নিউট্রালিটি’ বা ইন্টারনেট সমতার মূল শর্তগুলো ভঙ্গ করে।
এই খোলা চিঠিটিতে ৬৭টি ডিজিটাল রাইট গ্রুপ স্বাক্ষর করেছে যার মধ্যে রয়েছে আই ফ্রিডম উগান্ডা, ইকুয়েডর’স ইউসুরিয়াস ডিজিটেলস ও ইন্দোনেশিয়ার আইসিটি ওয়াচের মতো গ্রুপ। এই গ্রুপগুলো দাবি করেছে ইন্টারনেট ডট অর্গ মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সমান সুযোগ, নিরাপত্তা, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও উদ্ভাবনের মতো বিষয়গুলোকে হুমকির মুখে ফেলছে।
উন্মুক্ত চিঠির লিংক (https://www.facebook.com/notes/accessnoworg/open-letter-to-mark-zuckerberg-regarding-internetorg-net-neutrality-privacy-and-/935857379791271)
চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘আমাদের মনে হচ্ছে ফেসবুক মানুষের কাছে তাদের বক্তব্যে বেঠিকভাবে ইন্টারনেট সমতার ব্যাখ্যা দিচ্ছে এবং দেয়ালঘেরা একটি বাগান তৈরি করছে যাতে বিশ্বের দরিদ্র মানুষগুলো সীমিত সংখ্যক ওয়েবসাইট দেখা ও সেবা গ্রহণের সুযোগ পাবে। এ ছাড়া আমরা প্রত্যক্ষ করছি যে, ইন্টারনেট ডট অর্গকে পুরো ইন্টারনেট বিনা পয়সায় দেওয়ার নামে ভুলভাবে মানুষের কাছে ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে। কারণ, ইন্টারনেট প্রোভাইডাররা কেবল ফেসবুক ও স্থানীয় আইএসপি অনুমোদিত খুব কমসংখ্যক ইন্টারনেট সংযোগের আওতাধীন সেবা দিচ্ছে।’
২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক একটি অংশীদারি চুক্তির মাধ্যমে সারা বিশ্বের ইন্টারনেট সেবা বঞ্চিত দুই তৃতীয়াংশ মানুষের কাছে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছানোর লক্ষ্যে ইন্টারনেট ডট অর্গ প্রতিষ্ঠিত হয়। ফেসবুক ছাড়াও এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হয় এরিকসন, মিডিয়াটেক, নকিয়া, অপেরা, কোয়ালকম ও স্যামসাং। এই উদ্যোগের অধীনে গত বছরে প্রথম যে পণ্যটি ছাড়া হয় তা হচ্ছে একটি মোবাইল অ্যাপ যা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে স্বাস্থ্য, চাকরি ও স্থানীয় তথ্য সেবাগুলো মোবাইল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিনা খরচায় দেওয়ার কথা বলা হয়।
এসব সেবার মধ্যে রয়েছে অ্যাকুওয়েদার, ফেসবুক, মেসেঞ্জার, গুগল সার্চ, উইকিপিডিয়া, স্থানীয় খবর, স্বাস্থ্য ও চাকরির বেশ কিছু সাইট।
ইন্টারনেট ডট অর্গ প্রথম চালু হয় জাম্বিয়াতে এরপর তানজানিয়া, কেনিয়া, ঘানা, কলাম্বিয়া, ভারত ও বাংলাদেশে। এই অ্যাপটির মাধ্যমে বেসিক কিছু সেবা বিনা মূল্যে দিয়ে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, তাদের আশা এতে আরও বেশি মানুষকে অনলাইনে আনা যাবে এবং তাদের গুরুত্বপূর্ণ অনেক সেবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারবে যা তারা অন্য কোনোভাবে পেত না।
তবে, ফেসবুকের এই উদ্যোগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ধাক্কা এসেছে ভারত থেকে। এ বছরের এপ্রিল মাসে ভারতের প্রযুক্তি ও ইন্টারনেট কোম্পানির কয়েকটি গ্রুপ এই উদ্যোগ থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। তারা দাবি করে এতে নেট নিউট্রালিটি বা ইন্টারনেট সমতার জন্য হুমকি তৈরি হবে। ইন্টারনেট সমতা হচ্ছে, ইন্টারনেটের দুনিয়ায় সব ওয়েবসাইটকে সমান গুরুত্ব দিতে হবে এবং সমানভাবে বিবেচনা করে তা দেখার সুযোগ রাখতে হবে।
এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে কোয়ার্টজ নামের প্রযুক্তি বিষয়ক ওয়েবসাইটের এক প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছিল, উন্মুক্ত ওয়েবের পরিবর্তে ফেসবুকের মালিকানাধীন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যদি অধিকসংখ্যক মানুষ প্রথমবারের মতো অনলাইনের সঙ্গে যুক্ত হয়, তারা ইন্টারনেট সম্পর্কে যা জানবে তা হবে বিকৃত একটি ধারণা। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল, লাখো ফেসবুক ব্যবহারকারীরা যে ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন সে সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই।
ডিজিটাল রাইটস গ্রুপ তাদের উন্মুক্ত চিঠিতে লিখেছে যে, যাদের ইন্টারনেট সুবিধা নেই তাদের কাছে ফেসবুকের কম খরচে সহজলভ্য ইন্টারনেট পৌঁছানোর লক্ষ্যকে তারা সমর্থন করে, কারণ তাদের দাবি অনেক গ্রুপই দীর্ঘদিন ধরেই বৈষম্যহীন উপায়ে উন্মুক্ত ইন্টারনেট সুবিধা বাড়াতে কাজ করছে। তবে তাদের অভিযোগ হচ্ছে— ইন্টারনেট ডট অর্গের ‘জিরো রেটিং’ পদ্ধতির ব্যবহার নিয়ে যাতে নির্দিষ্ট নেটওয়ার্কের কিছু গ্রাহককে নির্দিষ্ট কিছু সেবা বা অ্যাপ্লিকেশন বিনা খরচে ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হয় বা ওই সাইট বা অ্যাপগুলো ব্যবহারে ডাটা প্ল্যান থেকে খরচ হয় না।
চিঠিতে বলা হয়, এ পদ্ধতিটি বৈষম্যমূলক হওয়াতে কানাডা, নেদারল্যান্ডস, স্লোভেনিয়া, চিলির মতো বেশ কিছু দেশে তা নিষিদ্ধ বা নিয়ন্ত্রিত। এ ধরনের চুক্তিতে বাকস্বাধীনতা ও সমতার বিষয়টি হুমকি হয়ে দাঁড়াবে কারণ সার্ভিস প্রোভাইডাররা কোন ইন্টারনেট সেবাটি অন্যটির চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে সে সিদ্ধান্ত নেবে। এতে তথ্যের অবাধ প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে।
ডিজিটাল রাইটস গ্রুপের উন্মুক্ত চিঠির জবার দিয়েছে ফেসবুক। তাতে অধিক সংখ্যক মানুষকে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়ার ক্ষেত্রে সমালোচকদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ফেসবুকের সামঞ্জস্য আছে বলে দাবি করেছে ফেসবুক।
ফেসবুকের একজন মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আমরা মনে করি যত বেশি মানুষ ইন্টারনেটে আসবে, তারা এর সুবিধা বুঝতে পারবে এবং তারা যে সুবিধাগুলো পাচ্ছে তার চেয়ে আরও বেশি সেবা ব্যবহার করতে চাইবে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমরা অপারেটরদের সঙ্গে মানুষকে বিনা খরচে বেসিক বা ন্যূনতম সেবা দিতে কাজ করেছি যাতে ব্যবহারকারীরা দ্রুত বেসিক ওই সেবাগুলোর পাশাপাশি অর্থ খরচ করে অন্যান্য সেবাগুলোও ব্যবহার করতে শুরু করে।
এর আগে এপ্রিল মাসে ইন্টারনেট ডট অর্গকে ‘প্ল্যাটফর্ম’ হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছিল ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। এই প্ল্যাটফর্মে সব ডেভেলপারদের ইন্টারনেট ডট অর্গের জন্য নিজস্ব সেবা তৈরির সুযোগ করে দেওয়ার কথা বলা হয়। এতে ব্যবহারকারীরা পুরো ইন্টারনেটের দুনিয়ায় আরও বেশি বিচরণ করতে পারবে বলে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ আশা করছে।
ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ সম্প্রতি এক ব্লগ পোস্টে লিখেছেন, ‘সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে ইন্টারনেট সুবিধার আওতায় আনার ক্ষেত্রে বাধা দেওয়ার জন্য নেট নিউট্রালিটির তর্ক করা উচিত নয়।’
মানুষকে ইন্টারনেটের আওতায় আনে এমন কোনো উদ্যোগকে বন্ধ করে দিলে তা সমাজের অন্তর্ভুক্তি বাড়াবে না বা ডিজিটাল বৈষম্য দূর করবে না। এতে শুধু আমরা ইন্টারনেট সুবিধার বাইরে থাকা বিশ্বের দুই তৃতীয়াংশ মানুষের কাছ থেকে আসা ধারণা ও তাদের অবদান থেকে বঞ্চিত হব।’
ভারতে কেন হোঁচট খাচ্ছে ইন্টারনেট ডট অর্গ
প্রযুক্তি বিষয়ক ওয়েবসাইট রিকোডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতে ইন্টারনেট ডট অর্গ হোঁচট খাওয়ার কারণ হচ্ছে এর ইন্টারনেটের প্রতি তির্যক দৃষ্টিভঙ্গি যার ফলে ‘আর্থিক বর্ণবাদ’ তৈরি হচ্ছে। এতে আর কারও সুবিধা হোক বা না হোক ফেসবুক আর এর অংশীদারদের সুবিধা হচ্ছে ঢের।
ইন্টারনেট ডট অর্গ ব্যবহারকারীরা যে ডেটা বিনা পয়সায় পান তা সরবরাহ করে ফেসবুকের সঙ্গে অংশীদার হিসেবে থাকা অপারেটর এবং তারা আশা করে এই ইন্টারনেট সুবিধাটুকু দিয়ে তারা ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের পুরো ইন্টারনেট দুনিয়ায় বিচরণ করতে একটি অতিরিক্ত ডাটা প্ল্যান কিনতে উদ্বুদ্ধ করতে পারবে।
ফেসবুকের দৃষ্টিতে ইন্টারনেট ডট অর্গ হচ্ছে সবার জন্য সমান জেতার সুযোগ। এতে ব্যবহারকারীরা কিছু সাইট খরচ ছাড়া ব্রাউজ করতে পারবে, টেলিকম অপারেটররা নতুন গ্রাহক ধরতে পারবে এবং নতুন ডাটা প্ল্যান কেনাতে পারবে আর ফেসবুক পাবে একেবারে আনকোরা কিছু ব্যবহারকারী যারা প্রথমবারের মতো ফেসবুক ব্যবহার করছে এবং ফেসবুকের নতুন বাজার তৈরি হবে।
ফেসবুকের এই পরিকল্পনাকে বড় ধাক্কা দিয়েছে ভারতে ইন্টারনেট সমতা নিয়ে তৈরি হওয়া বিতর্ক। ভারতের টেলিকম রেগুলেটরি অথরিটি গত মার্চ মাসে একটি প্রতিবেদন উন্মুক্ত করে যাতে ইন্টারনেট সমতার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এতে জনগণের মতামত চাওয়া হয়। ভারতে ইন্টারনেট সমতা নিয়ে কোনো আইন না থাকলেও দশ লাখেরও বেশি মানুষ ইন্টারনেট সমতার পক্ষে মত দেন। এর ফলে জিরো রেটিং সেবার মধ্যে পড়ে ইন্টারনেট ডট অর্গ নিয়ে তৈরি হয় বিতর্ক। ভারতের অনেক প্রতিষ্ঠান ইন্টারনেট ডট অর্গ থেকে সরে যায়। সমালোচকেরা বলেন, বিনা পয়সার সেবা দিতে থাকলে নতুন উদ্যোক্তারা বিপদে পড়ে যাবেন এবং প্রতিদ্বন্দ্বী সেবা তৈরিতে উৎসাহ কমে যাবে। এ ছাড়াও ভারতের টেলিকম অপারেটররা পরস্পরের শত্রু এ কথা সবাই জানে।
বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা যা বলেন
ইন্টারনেট ডট অর্গ নিয়ে বাংলাদেশের কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, বাংলাদেশ এখন প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অনেক ভালো করছে। এখন বিশ্বের বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর নজর আমাদের দিকে। ফেসবুক, গুগল থেকে শুরু করে যত বড় বড় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে নতুন সেবা নিয়ে আসবে ততই দেশের জন্য ভালো। আমাদের দেশের তরুণেরা উদ্বুদ্ধ হবে। নতুন সব সেবাকে আমাদের স্বাগত জানাতে হবে।
ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) বিশেষজ্ঞরা বলেন, ইন্টারনেট ডট অর্গের ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে, এটা বিনা পয়সার ইন্টারনেট সেবা না বা এটা মোটেও ফ্রি ইন্টারনেট না। এটি ব্যবহার করতে হলে নির্দিষ্ট অপারেটরের ডাটা প্ল্যান কিনতেই হবে। ওই ডাটা প্ল্যান থেকে ইন্টারনেট ডট অর্গ অ্যাপ ব্যবহার করে যেসব ওয়েবসাইট বা সেবা ব্যবহার করা যাবে সেগুলোর ক্ষেত্রে ডেটা খরচ বেঁচে যাবে।
ভবিষ্যৎ কী
ইন্টারনেট ডট অর্গ উদ্যোগটি খুব বেশিদিন আগে চালু হয়নি। এখন পর্যন্ত মাত্র ১১টি দেশে এটি চালু হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে এই উদ্যোগটিতে আরও নানা পরিবর্তন আসবে। এর নতুনত্বের কারণেই এর গুরুত্ব ও প্রভাব নিয়ে বেশি হইচই হচ্ছে। এখন ফেসবুক অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে মানুষকে সেবা দেওয়ার যে পথনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে গুগল বা টুইটারের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন কোনো সেবা চালুর আগে এই বিষয়গুলোতে অধিক সচেতন হয়েই মাঠে নামতে পারবে। (টেলিগ্রাফ, রিকোড, হিন্দুস্তান টাইমস, কোয়ার্টজ)

No comments:

Post a Comment