Monday 10 August 2015

অনলাইনে পণ্য কেনাকাটা : নকল হইতে সাবধান

কয়েক দিন আগের ঘটনা। ফেসবুকে একজন ক্রেতা কয়েকটি ছবিসহ একটা পোস্ট দেন। তিনি অনলাইনে বিকিকিনির একটা ওয়েবসাইট থেকে স্মার্টফোনের জন্য বহনযোগ্য চার্জার (পোর্টেবল চার্জার নামে বেশি পরিচিত) কিনেছিলেন। কেনার পর স্মার্টফোন চার্জ দিতে গিয়ে দেখেন সেটি দিয়ে ফোনের চার্জ হচ্ছে অত্যন্ত ধীরগতিতে।
 এই ক্রেতার কারিগরি জ্ঞান রয়েছে।  তাই তিনি পোর্টেবল চার্জারটা খুলে ফেলেন। ওর মধ্যে থাকা চারটি ব্যাটারির দুটিতে সংযোগ দেখতে পান তিনি। কৌতূহল বাড়ে,  সংযোগ ছিল না এমন দুটি ব্যাটারি ভেঙে ফেলেন তিনি। তারপর তাঁর চক্ষু তো চড়কগাছ। ওই দুটি ব্যাটারি ভরা ছিল উন্নতমানের বালুতে!
আরেকটি ঘটনা বহনযোগ্য হার্ডডিস্ক নিয়ে। এটাও একটি জনপ্রিয় ই-কমার্স সাইট থেকে কেনা। সাইটে বলা হয়েছিল, এর তথ্য ধারণক্ষমতা ২ টেরাবাইট। দাম কম, বাড়িতে পণ্য এলে তবে টাকা পরিশোধ করতে হয়—এসব সুবিধার হাতছানিতে ঢাকার একজন ক্রেতা অর্ডার দেন এই হার্ডডিস্কের জন্য। যথাসময়ে চলেও আসে এটা। ‘তোশিবা’ ব্র্যান্ডের লোগোখচিত হার্ডডিস্কটি ব্যবহার করতে গিয়ে দেখেন কম্পিউটার ২ টেরাবাইট (১ টেরাবাইট = ১০২৪ গিগাবাইট) দেখাচ্ছে না। এই হার্ডডিস্কের ধারণক্ষমতা দেখানো হচ্ছে মাত্র ২ গিগাবাইট। তখনই হার্ডডিস্কটা খুলে ফেলেন তিনি। দেখা যায় ওটা আসলে হার্ডডিস্ক নয়। হার্ডডিস্কের খাপের মধ্যে একটি ২ গিগাবাইটের পেনড্রাইভ বসানো। ফলে কম্পিউটারে সংযোগ দেওয়ার পর এই পেনড্রাইভের ধারণক্ষমতাই দেখা গেল।
যাতায়াতের সমস্যা, আর দীর্ঘ সময়ের কথা চিন্তা করে বাজারে গিয়ে কেনাকাটা করার চেয়ে ক্রেতারা এখন ঝুঁকছেন অনলাইন কেনাকাটায়। অনলাইনে নতুন–পুরোনো চমকপ্রদ প্রযুক্তিপণ্য বিক্রিও হচ্ছে দেদার। অনলাইন দোকানগুলোর পণ্যে আবার দামটাও কম থাকে। তাই ক্রেতারা সহজেই আকৃষ্ট হচ্ছেন। সুবিধা যেমন আছে তেমনি অসুবিধাও কম নয়। অনেক সাইটেই বিক্রি হচ্ছে নকল প্রযুক্তিপণ্য। ক্রেতা সস্তা দেখে কিনছেন এবং প্রতারণার শিকার হচ্ছেন।
বিভিন্ন ব্র্যান্ডের স্মার্টফোন থেকে শুরু করে স্পিকার, হার্ডডিস্ক ড্রাইভ, বহনযোগ্য চার্জারসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি পণ্য বিক্রি হয়ে থাকে অনলাইনে। ওয়েবসাইট থেকে পণ্য কিনে ঠকেছেন এমন একজন মিরপুরের ইশরাত জাহান। তিনি বললেন, ‘আমি জনপ্রিয় একটা ওয়েবসাইট থেকে একটি স্পিকার কিনেছিলাম। পরে দেখা গেল একটা স্পিকার ঠিকভাবে চললেও অন্যটি চলছে না। অনলাইনে ছবি কিংবা বর্ণনা দেখে মনে হয় পণ্যটির মান খুব ভালো। কিন্তু হাতে পাওয়ার পরে দেখলাম অনলাইনে যেটা দেখেছি তার সঙ্গে ছবি কিংবা বর্ণনার কোনো মিলই নেই। পরে অনেকবার গ্রাহকসেবার নম্বরে ফোন দিয়েও কাউকে পাইনি। যদিও একবার ফোন ধরেছিল। সমস্যার কথা বললে তারা “দেখছি” বলে আর যোগাযোগ করেনি।’
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি এবং ই-কমার্স সাইট এখনই ডটকমের চেয়ারম্যান শামীম আহসান বললেন, ‘আমরা বেসিস ই-কমার্স জোট থেকে নকল প্রযুক্তিপণ্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিয়েছি। নকল প্রযুক্তিপণ্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে আমাদের বেসিস ই-কমার্স জোটের ভূমিকা হবে কঠোর। আমাদের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে নকল কোনো পণ্য বিক্রয়ের অভিযোগ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনে ক্রেতাকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।’
একই রকম কথা বললেন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সভাপতি রাজীব আহমেদ। তিনি বলেন, ‘অনেক ক্রেতা কম দামে পণ্য পেতে বিভিন্ন ই-কমার্স সাইটে কেনাকাটা করেন। পরে ক্রেতার হাতে পৌঁছালে অনেক সময়ই দেখা যায় পণ্যটি নকল। এ ধরনের অভিযোগ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আসে ফেসবুক পেজের মাধ্যমে অনলাইন বেচাকেনার ক্ষেত্রে।’
ই-ক্যাবের সদস্য কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য কেনার ক্ষেত্রে ক্রেতা প্রতারিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান রাজীব আহমেদ।
অন্যদিকে শ্রেণিবদ্ধ বিজ্ঞাপনভিত্তিক বেচাকেনার সাইট বিক্রয় ডটকমের বিপণন পরিচালক মিশা আলী জানালেন, ‘নকল কোনো প্রযুক্তিপণ্যের বিজ্ঞাপন দিলে সেটি আমরা বাতিল করে দিই। এ জন্য আমাদের একটি বিভাগ সব সময় নজরদারির সঙ্গে কাজ করছে।’
বিক্রয় ডটকমে রেপ্লিকা বা ক্লোন নামের বিভা​গ রয়েছে। এমন বিভাগ কেন রাখা হয়েছে—এ প্রশ্নের জবাবে মিশা আলী জানান, কেউ যদি অনুরূপ কিংবা ক্লোন পণ্য বিক্রয় করতে চায়, তাহলে সেগুলোকে সরাসরি নকল বলাই ভালো। এতে ক্রেতারা সতর্ক থাকতে পারেন। পাশাপাশি ক্রেতাদের এমন চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখেই এই বিভাগ চালু আছে।
অনলাইন থেকে পণ্য কিনে প্রতারিত হলে ক্রেতার করণীয় কী? বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানজিম আল ইসলাম বললেন, ‘অনলাইনে নকল বা ভুয়া পণ্য বিক্রয় আইনগত অপরাধ। কয়েকটি আইনের আওতায় একে আনা যেতে পারে। প্রথমত এমন নকল বা ভুয়া পণ্য বিক্রির জন্য অনলাইন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি অনুযায়ী প্রতারণার অভিযোগ আনা যেতে পারে। যদি উল্লেখ্য কোনো পণ্য শর্ত দিয়ে বিক্রয় করা হয় কিন্তু শর্ত অনুযায়ী কাজ না করে, সে ক্ষেত্রে সে পণ্য দ্বারা ক্ষতি হলে সেটি দেওয়ানি আদালতে ক্ষতিপূরণের মামলা করা যাবে। আবার তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের আশ্রয়ও নেওয়া যাবে।’
তানজিম আল ইসলাম আরও বলেন, ‘কোনো অনলাইন প্রতিষ্ঠানে অর্ডার দেওয়ার পর হাতে নকল বা ভুয়া যদি আসে, সে ক্ষেত্রে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ আনা যাবে। তবে সেটা পণ্য হাতে পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে আনতে হবে। পরে তারা যাচাই-বাছাই করে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর মামলা দায়ের করবে ভোক্তার পক্ষে।
দেশে ই–কমার্সের বিকাশ ঘটতে শুরু করেছে। এই সময়ে এই খাতে সংশ্লিষ্টদের আর​ও সচেতন থাকা দরকার। কোনোভাবেই ক্রেতা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন।
কেনার আগে খেয়াল রাখুন
* অনলাইনে পণ্যের মূল্যের সঙ্গে প্রচলিত বাজারমূল্য মিলিয়ে দেখতে হবে। অনলাইনে যদি পণ্যটির দাম বেশি কম থাকে, তবে বুঝতে হবে পণ্যটিতে সমস্যা রয়েছে।
* প্রযুক্তিপণ্য হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৈদ্যুতিক বা অন্য কোনো যন্ত্রের সঙ্গে সংযোগ দিয়ে পরীক্ষা করে নিতে হবে।
*অনলাইনে স্মার্টফোন কেনার ক্ষেত্রে বাক্স এবং ফোনের আইএমইআই নম্বর মিলিয়ে দেখতে হবে।

No comments:

Post a Comment